জুলাই গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মাধ্যমে একটি জাতির স্বৈরাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার ইতিহাস পৃথিবীতে খুব কম আছে। দেখতে দেখতেই এই অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি উদযাপন শুরু হয়েছে।
তবে এখনো অনেকের মনে দানা বেঁধে আছে অনেক প্রশ্ন। একটা সাধারণ অরাজনৈতিক ছাত্র আন্দোলন কীভাবে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করে টানা সাড়ে ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটালো, এ প্রশ্ন অনেকেরই। সেসময় ছাত্র সংগঠনগুলোর ভূমিকাই বা কী ছিল সেটিও জানার আগ্রহ অনেকের।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শুরু থেকেই পরোক্ষভাবে এর সঙ্গে জড়িত ছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও ইসলামী ছাত্রশিবির। দুই সংগঠনই আন্দোলন যাতে ট্যাগিংয়ের শিকার হয়ে প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সেই চেষ্টা অব্যাহত রেখেই অংশগ্রহণ জারি রেখেছিল। ১৭ জুলাইয়ের পরে উভয় সংগঠনই তাদের নিজ ব্যানারে অংশ নেওয়া শুরু করে। কার ভূমিকা কী ছিল, তা নিয়ে দুই সংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শাখার তৎকালীন সভাপতির সঙ্গে কথা বলেছে জাগো নিউজ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস আন্দোলনে তাদের সম্পৃক্ততা প্রসঙ্গে বলেন, জুলাইয়ের আন্দোলনে শুরু থেকেই আমাদের অংশগ্রহণ ছিল। প্রথম দিকে শাহবাগকেন্দ্রিক আন্দোলনে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেতাকর্মীরা নিজ উদ্যোগেই অংশগ্রহণ করত। কিন্তু জুলাইয়ের ৫ তারিখ আমাদের কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সঙ্গে ঢাবি ছাত্রদলের একটি মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, নেতৃবৃন্দ ছাড়া বাকি যারা আছে তারা সংগঠিত হয়ে এ আন্দোলনে অংশ নেবে। আমাদের পক্ষ থেকে এ আন্দোলনে যাতে কোনো সমস্যা সৃষ্টি না হয় কিংবা আন্দোলনের গতিবিধি বৃদ্ধিতে আমরা যাতে আরও সহায়তা করতে পারি সেই চেষ্টা শুরু করি। আমরা সামনে যাওয়ার কারণে এই আন্দোলনকে বিরোধীদলের আন্দোলন বলে দমন করা শুরু করতে পারে, এ আশঙ্কার কারণে আমরা দ্বিতীয় সারিতেই থাকি। এমন দিকনির্দেশনাই আমাদের দেওয়া হয়।
গণেশ চন্দ্র রায় বলেন, একদম শুরুর দিক থেকে জুলাইয়ের ১৫-১৬ তারিখ পর্যন্ত আমরা অনেকটা প্যাসিভ পজিশনেই ছিলাম। জুলাইয়ের ১৪ তারিখ যখন শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকার’ ট্যাগ দেন আর এটা নিয়ে শিক্ষার্থীরা একটা প্রতিক্রিয়া দেখায়, এরপর থেকেই মূলত ছাত্রদলের সামনে আসা শুরু হয়। কারণ এত খারাপ একটা কথা শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের বলেছেন, সেটার একটা মোক্ষম জবাব ছাত্রদল ছাড়া দেওয়ার মতো কেউ ছিল না। আমরা এর জবাব দিয়েছি। শিক্ষার্থীরা যখন ‘তুমি কে আমি কে—রাজাকার রাজাকার’ স্লোগান দেয় সেটাকে ‘কে বলেছে কে বলেছে—স্বৈরাচার স্বৈরাচার’ পর্যন্ত বর্ধিত করে নিয়ে যাওয়া, ১৫ জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার পর তাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে হামলার প্রতিরোধ পর্যন্ত ছাত্রদল করেছে। ওইদিন সন্ধ্যায় শহীদুল্লাহ হলের সামনে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগকেও প্রতিহত করে ছাত্রদল। ১৬ জুলাই শহীদ মিনার থেকে যে মিছিলটি হয় সেটিতেও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সব স্তরের নেতাকর্মীরাই ছিলেন।
সংগঠনের কৌশলের কথা উল্লেখ করে ঢাবি ছাত্রদলের সভাপতি বলেন, এখানে একটি বিষয় বলা উচিত, পূর্বপরিকল্পনার অংশ হিসেবে দল ঘোষিত কোনো কর্মসূচি ছাড়া কেন্দ্রীয় সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, আমি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সম্পাদক এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করিনি। ১৭ তারিখ যখন কফিন মিছিল হয়, সেখানেও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেন। এরপর ১৭ তারিখে হল খালি করা হলে ১৮ তারিখ থেকে যে যেখানে ছিল, সেখান থেকেই পুরো আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাধারণ শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের সঙ্গে মিলে অভূতপূর্ব একটি ভূমিকা পালন করেন। আমরা এজন্য তাদের নিয়ে গর্বিত, তারা তাদের সর্বোচ্চ সাহসিকতা দেখিয়েছেন।
আন্দোলনের কঠিন সময়ের ঘটনার বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, পরবর্তীকালে যখন ইন্টারনেট শাটডাউন হয়, এর মাঝখানে যত আন্দোলন হয়েছে সবখানে কিন্তু জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। শহীদের যে তালিকা, একক ছাত্র সংগঠন হিসেবে সর্বোচ্চ সংখ্যক শহীদ কিন্তু ছাত্রদলেরই। জুলাই শেষ হয়ে যখন আগস্টের ৩ তারিখ শহীদ মিনারে কর্মসূচি হয় সেখানেও ছাত্রদল ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রদলের বিভিন্ন নিশানা ধ্বংস করা থেকে শুরু করে হাসিনার প্রতিকৃতিতে জুতা, ময়লা নিক্ষেপে নেতৃত্ব দিয়েছেন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরাই। ৫ আগস্ট চাঁনখারপুলে পুলিশ যখন গুলিবর্ষণ করছিল, সেখানেও প্রতিরোধ করেছে ছাত্রদল। এই পুরো আন্দোলনের সময়ই ছাত্রদল তাদের সাংগঠনিক শৃঙ্খলার মধ্যে থেকেই অংশ নিয়েছে। প্রতিদিন অংশ নেওয়ার সময়ও প্রতিটি ইউনিটের নেতাদের পারস্পরিক যোগাযোগ ছিল। যারা আহত হয়েছেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেছেন, যারা শহীদ হয়েছেন তাদের তালিকা রাখার চেষ্টাসহ সবকিছুই সুশৃঙ্খলভাবে করা হয়েছে। এখানে কোনো কিছুই পরিকল্পনার বাইরে ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের তৎকালীন সভাপতি ও বর্তমানে কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক সাদিক কায়েম শিবিরের ভূমিকা তুলে ধরে বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান দেশের আপামর ছাত্র-জনতার ক্ষোভের চূড়ান্ত বিস্ফোরণ। এ অভ্যুত্থানে সব স্তরের নাগরিকের সঙ্গে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরও অংশগ্রহণ করেছিল। আন্দোলনের শুরুতে অর্থাৎ ৫ জুন যেদিন কোটা পুনর্বহাল করে হাইকোর্টে রায় দেওয়া হয় সেদিনই নাহিদ, আসিফ আমাকে ফোন দেয়। আন্দোলন কীভাবে সমন্বয় করা যায় সে ব্যাপারে জানতে চায়। প্রথমদিকে আমাদের যোগাযোগ হতো নাহিদ, আসিফ, মাহফুজদের সাথে। তাদের সাথে আন্দোলনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আমরা আলোচনা করতাম। ৫ জুন যখন শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে লাইব্রেরি থেকে রাস্তায় নেমে আসে সেদিন আমাদের নেতাকর্মীরাও সেখানে ছিল। এরপর ঈদের আগ পর্যন্ত যে ছোট ছোট কর্মসূচি পালিত হয়েছিল, সেগুলো নাহিদ-মাহফুজসহ সবার সাথে আলোচনা করেই ঠিক করা হতো। মূলত তাদের সাথে শিবিরের পক্ষ থেকে যোগাযোগটা রক্ষা করতাম আমি এবং ফরহাদ (তৎকালীন ঢাবি শিবিরের সেক্রেটারি)।
আন্দোলন সংগঠিত করার ব্যাপারে সাদিক কায়েম বলেন, কোটা আন্দোলন থেকে শুরু হলেও আমাদের সবারই মূল লক্ষ্য ছিল ফ্যাসিবাদের পতন। এর মধ্যেই ঈদ চলে আসে, আমরা পরিকল্পনা করি এই সময় যাতে আন্দোলন আরও সংগঠিত করা যায়। কোনদিন কী কর্মসূচি দেওয়া যায় এসব নিয়ে আমরা কেন্দ্রীয় শিবির এবং ঢাবি শিবিরের সাবেক সভাপতিদের সাথে আগে আলাপ করতাম, পরে সেটা আবার মাহফুজ, নাহিদদের সাথে শেয়ার করতাম। পরে সেটা আরও আলোচনার পর তারা চূড়ান্ত করত। ঢাকার বাইরের আন্দোলন সংগঠিত করতেও শিবির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ প্রতিটি শহরে আমাদের জনশক্তি জনতাকে সাথে নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে গেছে। পরে একটা প্ল্যাটফর্মের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে আমি মাহফুজকে বিষয়টি জানালে মাহফুজ একটি কমিটি গঠনের বিষয়ে বলে। পরে একটি সমন্বয়ক কমিটি করা হয়।
আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে শিবিরের অংশগ্রহণের কথা জানিয়ে শিবিরের এই নেতা বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক মাঠপর্যায়ে লজিস্টিক সব সাপোর্ট আব্দুল কাদেরের সাথে সমন্বয় করে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্র আন্দোলন বিষয়ক সম্পাদক জায়েদুল হক ম্যানেজ করতেন। অন্যান্য সংগঠন ও অ্যাক্টিভিস্টদের সাথেও তিনি যোগাযোগ রক্ষা করতেন। ১৫ জুলাই শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হলে আমরা তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করি এবং ছাত্রলীগকে প্রতিরোধের পরিকল্পনা করি। আমরা সমন্বয়কদের জানাই, ছাত্রলীগের হামলার প্রতিশোধ নেব, ছাত্রলীগকে ক্যাম্পাস ছাড়া করব। পরে ১৭ জুলাই ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগ তাড়ানোতেও আমাদের নেতাকর্মীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়ে সমন্বয় করেছিল। সেদিন হল থেকে শিক্ষার্থীরা বের হয়ে যাওয়ার পরই সন্ধ্যায় আমরা সব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এবং মহানগর ইউনিটের নেতাকর্মীদের সাথে অনলাইনে একটি মিটিং করি এবং তাদের আন্দোলন সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে জানাই। ১৮ জুলাই থেকে ২ আগস্ট পর্যন্ত প্রথম সারির সমন্বয়কদের অনুপস্থিতিতে আন্দোলনটা আমরা সমন্বয় করেছি।
সমন্বয়কদের নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছেন উল্লেখ করে সাদিক কায়েম বলেন, সেই সময় আমি সমন্বয়কদের সেফ হাউজের ব্যবস্থা করেছি, তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছি। একেক জনকে একেক জায়গায় রেখে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি, পাশাপাশি ৯ দফা তৈরি করা, সেটা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে অ্যাস্টাবলিশ করার সব প্রয়োজনীয় কাজ করেছি। একইসাথে টিভিতে আন্দোলন বন্ধ হয়ে গেছে, এমন প্রোপাগান্ডার বিপরীতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার বার্তাগুলো আমরা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে পৌঁছিয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের রায়হান উদ্দিন আমাদের প্রেস রিলিজগুলো তৈরি করতেন। এ সময় আমরা বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে আহত ও নিহতদের তালিকা করেছি। এই কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন ঢাবি শিবিরেরে আরেক কর্মী আরাফাত হোসেন ভূইয়া।
তিনি আরও বলেন, যখন ইন্টারনেট সীমিত আকারে চালু করা হলো, তখন ছয় সমন্বয়ক আটক হলে দ্বিতীয় স্তরের সমন্বয়ক, অর্থাৎ আব্দুল কাদের, মাহিন সরকার, রিফাত রশিদ এবং হান্নান মাসউদের সাথে আমরা কর্মসূচি সমন্বয় করা শুরু করলাম। পরিস্থিতি বিবেচনায় বিভিন্ন কর্মসূচি ঠিক করা ও সেগুলোর নাম নির্ধারণ করা এবং প্রেস রিলিজের খসড়া তৈরি করে আমরা তাদের কাছে পৌঁছাতাম। তারা সেগুলো নিয়ে আলোচনা করে চূড়ান্ত করত। ছয় সমন্বয়ক ছাড়া পাওয়ার পর আবার তাদের সাথে যোগাযোগ শুরু হয়। তাদের সাথে আলাপ করে পরে নাহিদ ইসলাম এক দফার ঘোষণা দেন। ওইদিনই আমি ড. মুহম্মদ ইউনূসের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম হই এবং পরদিন নাহিদ, মাহফুজ, আসিফ এবং আমি তার সাথে মিটিং করি। নাহিদ-আসিফ ৬ (জুলাই) তারিখ মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি দিলে আমরা তাদের দেরি না করে ৫ তারিখই দেওয়ার জন্য পরামর্শ দেই। পাশাপাশি তাদের নিশ্চিত করি, যত লোকজন লাগে সব আমরা দেব। আমাদের পরামর্শে আসিফ ঘোষণা দেয়, পড়শু নয়, কালই মার্চ টু ঢাকা। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর সেদিন সন্ধ্যায় আমি প্রথম জনসম্মুখে আসি।